• ১৭ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চিলির অক্টোবর: ইতিহাসের নতুন পাতা

0

শান্তুনু দেঃ নেরুদা, ভিক্টর হারা, আলেন্দের চিলিতে ইতিহাসের নতুন পাতা। পিনোচেতের সংবিধান বদলে নতুন সংবিধান চেয়ে বিপুল জনাদেশ। মেকিস্কোর বামপন্থী দৈনিক লা জর্নাদা’র ভাষায়, ‘নয়া উদারবাদের অবসান’। গণভোটে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ রায় দিয়েছেন নতুন সংবিধানের পক্ষে। কমিউনিস্টসহ প্রগতিশীলদের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন সংবিধান তৈরিতে সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মঞ্চকেই বেছে নিয়েছেন ৭৯ শতাংশ ( প্রেনসা লাতিনা)। জেনারেল পিনোচেতের ভূতের অবসান। জয়ের আনন্দে রবিবার রাতভর রাস্তায় মানুষ। সান্তিয়াগোর প্রাণকেন্দ্রের ঢাউস ব্যানার: ‘বিদায় জেনারেল!’ ‘ নতুন সংবিধান চেয়েছি আমার শ্রেণির জন্য।’ পিনোচেতের সংবিধানের বদল চেয়ে এই ছিল প্রতিবাদীদের ব্যানারের প্রত্যয়ী বার্তা। বলিভিয়ার পর এবারে চিলি। লাতিন আমেরিকা লড়ছে। গণবিদ্রোহ থেকে ব্যালটে। অভিমুখ ফের বামপন্থায়। এবং লাতিন আমেরিকা শুধু লড়ছেই না। ভাঙছে নয়া উদারবাদী মডেলকে, তার মূল অক্ষ চিলি থেকে। এই গ্রহে নয়া উদারবাদের প্রথম পরীক্ষাগার ছিল চিলি। এহেন চিলিতে দক্ষিণপন্থীদের বরাবরের দাপট ভেঙে বামপন্থীদের, বিশেষ করে ব্রড ফ্রন্টের জন্য তৈরি হয়েছে এক নতুন সম্ভাবনা। চিলির অক্টোবর। গত একবছর ধরে মানুষ রাস্তায়। এক প্রতিরোধের বিস্ফোরণ। রুখে দাঁড়িয়েছে নয়া উদারাবাদের বিরুদ্ধে, ডেভিড হার্ভে যাকে বলেছেন, ‘উৎখাতের মাধ্যমে কেন্দ্রীভবন’। স্বাভাবিক।
শ্রেণিসংগ্রামের পাটিগণিত:
এই বিশ্বের সবচেয়ে অসাম্যের দেশগুলির অন্যতম চিলি। জিডিপি বৃদ্ধির হার ২০১৮-তে ছিল ১.১ শতাংশ, যেখানে বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলির মুনাফা বেড়েছে ১০-গুণের বেশি। কী কারণে এই প্রকট ব্যবধান, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় নি। চিলি দেখেছে জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্বাস্থ্য, ওষুধ, পরিবহন, শিক্ষা এমনকি হিমবাহের বেসরকারিকরণ। ‘উৎখাতের মাধ্যমে কেন্দ্রীভবনের’ এক ধ্রæপদী উদাহরণ। ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের অধিকাংশের জীবনধারণ। যে চিলিতে মাথাপিছু আয় বছরে ২৫,০০০ ডলার, সেখানে অর্ধেক শ্রমিকের বেতন মাসে ৫৫০ ডলারের কম। ধনীশ্রেষ্ঠ এক শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের সম্পদের ২৬.৫ শতাংশ, আর ১০ শতাংশের হাতে ৬৬.৫ শতাংশ। বিপরীতে, হতদরিদ্র ৫০ শতাংশের মাত্র ২.১ শতাংশ। প্রকট মেরুকরণের স্বাভাবিক পরিণতি বিক্ষোভ। রাষ্ট্রপতি সেবাস্তিয়ান পিনেরা জরুরি অবস্থা জারি করেন। রাস্তায় সেনা নামান। তবু লাভ হয় নি। প্রতিদিন বিক্ষোভের আয়তন বেড়েছে। প্রতিরোধের মেজাজ চড়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটসের হিসেব: নিহত ২০, জখম ১,১৩২, আটক ৩,৫৩৫। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, আটক থাকার সময় সশস্ত্রবাহিনীর হাতে অত্যাচারিত হয়েছে ৪৩টি শিশু। ঘটেছে ১৯টি যৌন হিংসার ঘটনা, এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত। তবু ছিল অকুতোভয়। জরুরি অবস্থা, সেনা জওয়ানের বেয়নট উড়িয়ে এক রাজধানী সান্তিয়াগোতেই রাজপথে ১২ লক্ষ মানুষ। বাকি দেশে রাস্তায় আরও ৮ লক্ষ। শুরু ১৪ অক্টোবর, মেট্রোরেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে হাইস্কুলের ছাত্রদের বিক্ষোভ দিয়ে। মেট্রোর ভাড়া ৩.৭৫ শতাংশ (৩০ পেসো) বাড়িয়েছিলেন পিনেরা। ১৮ অক্টোবর, সান্তিয়াগোর মেট্রোরেলের ১৪৬টি স্টেশনের ঝাপ বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। ভাঙচুর চালায় সত্তরটি স্টেশনে, কুড়িটিতে আগুন জ্বালায়। স্বস্তঃস্ফূর্ত এই প্রতিবাদ থেকেই সরকারের উদারনীতির বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রতিবাদের উত্থান। জেনারেল পিনোচেতের স্বৈরাচারী জমানার পর এই প্রথম। ১০-১১ আগস্ট, ১৯৮৩: পিনোচেত রাস্তায় নামিয়েছিলেন ১৮,০০০ সেনা। এবারে পিনেরা নামান ৯,৫০০ সেনা। রাস্তায় সেনাটহল, সাঁজোয়া গাড়ি। কারফিউ জারি করেছেন। সান্তিয়াগোতে শেষবার কারফিউ জারি করা হয়েছিল ১৯৮৭-তে। ১৯ অক্টোবর, রাষ্ট্রপতি পিনেরা টেলিভিশন ভাষণে বলেন, ‘আমি দেশবাসীর কন্ঠস্বর শুনেছি।’ ভাড়াবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখেন তিনি। আশ্বাস দেন, ‘আমি জনগণের কথা শুনব, তবে আগে প্রতিবাদ থামাতে হবে।’ যদিও, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদীদের মেজাজ তখন তুঙ্গে। চারদিন বাদে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে পিনেরা ঘোষণা করেন, ‘আমরা এক শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, যারা বেপরোয়া হিংসা চালানোর জন্য প্রস্তুত।’ মাঝে ২৩-২৪ অক্টোবর, সিইউটি-সহ বাইশটি সংগঠনের ডাকে ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট। ধর্মঘটের প্রথম দিনে এক বিবৃতিতে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি অবিলম্বে জরুরি অবস্থার অবসানের দাবি জানায়। চায় বর্বর দমনপীড়নের অবসান। অ্যাক্টিভা রিসার্চের অনলাইন সমীক্ষায় ৮০ শতাংশই জানিয়ে দেন তারা প্রতিবাদ সমাবেশের পক্ষে। ক্ষোভের পারদ চড়তে চড়তে শেষে বিস্ফোরণ। রাষ্ট্রপতির চোখরাঙানি উড়িয়ে ২৫ অক্টোবর রাস্তায় নামেন লক্ষ-লক্ষ মানুষ। চিলির সাংবাদিক পল ওয়ালডেরের কথায়, ‘কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে ছিলেন তাদের অভিভাবকরা, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দাদু-দিদারা।’ ব্যানারে ‘জাগ্রত চিলি’, পিনেরাকে কটাক্ষ করে প্ল্যাকার্ডে ‘আমরা এখন যুদ্ধে!’ অভূতপূর্ব এই সমাবেশ দেখে ‘মার্কিন বিবেক’ নোয়াম চমস্কি বলেন, গত চারদশক ধরে যে নয়া উদারবাদের আস্ফালন চলছে, তাতে এই পরিণতি প্রত্যাশিতই ছিল।
প্রতিবাদে ওয়ার্কার্স ইউনাইটেড সেন্টার (সিইউটি)’র মতো দাপুটে ট্রেড ইউনিয়ন থেকে ছাত্ররা। নারীবাদী থেকে পরিবেশবাদীরা। আন্দোলন তখন অন্য মাত্রায়। নিছক ‘৩০-পেসো নয়, ৩০-বছরের অসাম্যের অবসান।’ তারা চান নয়া উদারবাদের বিকল্প। রাষ্ট্রপতি পিনেরার অবিলম্বে পদত্যাগ। একটি নতুন সরকার। তারা চান মজুরিবৃদ্ধি, যা হবে দারিদ্রসীমার উপরে। ৪৫ নয়, সপ্তাহে ৪০-ঘণ্টা কাজ। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, যৌথ দর কষাকষির নিশ্চয়তা। নাগরিক পরিষেবাসহ স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের জাতীয়করণ। বেসরকারি পেনশন তহবিলের অবসান। ছাত্রদের ঋণমকুব। জলের কর ব্যবস্থার অবসান। প্রগতিশীল কর-কাঠামো। একটি নতুন অভিবাসী নীতি। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, রাজনীতি থেকে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন। সবমিলিয়ে একটি নতুন সংবিধান। তার খসড়া লেখার জন্য একটি নতুন গণপরিষদ। চিলির বিলিওনেয়ার তালিকায় পিনেরার স্থান সপ্তম। সম্পত্তির পরিমাণ ২৭০ কোটি ডলার। এয়ারলাইন্স, সুপারমার্কেটস, টেলিভিশন, ক্রেডিট কার্ড থেকে ফুটবল পিনেরার সা¤্রাজ্য। পিনেরার ভাই হোসে আসলেই ছিলেন পিনোচেতের জমানার মন্ত্রী, যিনি চিলির জনকল্যাণকর ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ করেছিলেন। ব্রাজিলের বর্তমান অর্থমন্ত্রী পাউলো গুইদেস আসলে একজন ‘শিকাগো বয়’, যিনি সে সময় মিলটন ফ্রিডম্যানের ‘শিকাগো বয়েজের’ হয়ে চিলিতে নয়া উদারবাদের প্রথম পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। আর এখন সেই একই বিপর্যয়কর অর্থনীতির পরীক্ষা চালাচ্ছেন ব্রাজিলে। পিনোচেতের স্বৈরশাসন শেষে খনির বেসরকারিকরণ করে। তার মধ্যে বৃহত্তম ছিল এসকনদিদা যা আসলে বিশ্বের ৯ শতাংশ তামার ভাÐার। চিলির তামার থেকে আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ চলে যায় বিদেশী বহুজাতিক সংস্থার হাতে। আটজন মন্ত্রীকে অপসারিত করে নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের ঘোষণা করে ক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা করেন পিনেরা। পেনশন ও মজুরির বাড়ানোর সঙ্গেই বিদ্যুৎ ও জলের মাসুল স্থিতিশীল রাখার আশ্বাস দেন। বলেন হাইওয়ে টোল ট্যাক্স থেকে ওষুধের দাম কমাবেন, গুরুতর অসুস্থদের জন্য বীমা প্রকল্প চালু করবেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বেতন ছাঁটাই করবেন, উচ্চ আয়ের মানুষের উপর কর আরোপ করবেন।
২৮ অক্টোবর, রাষ্ট্রপতি পিনেরার সমর্থন নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশ। সংসদের চিলির কমিউনিস্ট পার্টি, হিউম্যানিস্ট পার্টির উদ্যোগে ব্রড ফ্রন্ট, ইকোলজিস্ট এবং অন্যান্য শক্তির সমর্থনে বিরোধীরা ঘোষণা করেন পিনেরার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক অভিযোগপত্রের জন্য তাদের কাছে রয়েছে যথেষ্ট সমর্থন। সোস্যালিস্ট পার্টি সই না করলেও, সংসদের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভায় এনিয়ে ভোটাভুটি হলে বিরোধীদের পাশে দাঁড়াবে বলে জানায়। অন্যদিকে, সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটে সমস্ত বিরোধীরা সাংবিধানিক সংস্কারের খসড়া পেশ করেন, যা ঠিক হবে গণভোটে, মানুষ নতুন সংবিধান চান কি না! সংসদের বাইরে-ভিতরে তুমুল চাপের মুখে গণভোটের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হন পিনেরা। বিদ্রোহে, ব্যালটে শেষে ফিরে এসেছেন ভিক্টোর হারা, আলেন্দে। সান্তিয়াগোর রাস্তায় পিনোচেত জমানায় শহীদ গায়ক-গীতিকার ভিক্টর হারার গান ‘শান্তিতে বাঁচার অধিকার!’
আলেন্দের প্রত্যয়, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নেই, উন্নততর সমাজ নির্মাণে মুক্ত মানুষ খুলবে মহান রাস্তা!’
লেখকঃসহযোগী সম্পাদক, ‘মাকর্সবাদী পথ’ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তাত্তি¡ক পত্রিকা।

Share.