দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাশেদ খান মেনন এমপি’র পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য

0

মাননীয় স্পীকার,
আপনাকে ধন্যবাদ। অভিনন্দন আপনাকে চতুর্থবারের মত স্পীকার নির্বাচিত হওয়ায়। (দ্বিতীয়বারের মত ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হওয়ায়) সংসদীয় রীতি অনুযায়ী প্রতিবারের মত এবারও আপনাদের অভিনন্দন জানাতে পারিনি বলে মনে খেদ রয়ে গেছে।

মাননীয় স্পীকার,
এবারের সংসদ কিছুটা বৈচিত্রপূর্ণ। এবারই সর্বপ্রথম এত অধিক সংখ্যক স্বতন্ত্র সদস্য সংসদে এসেছেন। ফলে সংসদে কিছু নতুন রীতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা এমন না হয় যাতে সংসদীয় রীতির সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়।

মাননীয় স্পীকার,
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এটি একটি নতুন অভিজ্ঞতা। নির্বাচনকে প্রতিদন্দ্বিতামূলক করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। দলের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে উপজেলা নির্বাচনকেও উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়ায় নতুন কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা জন্ম নেবে কিনা সেটা দেখার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সে ধরনের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলছেন। এই ব্যবস্থায় ধনীরাই থাকবে, গরিব-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ নয়। নির্বাচন কমিশন সেই লক্ষ্যে উপজেলা চেয়ারম্যানের জামানত এক লক্ষ, ভাইস-চেয়ারম্যানের জামানত ৭০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছেন।

মাননীয় স্পীকার,
মাননীয় রাষ্ট্রপতি সঠিকভাবেই বলেছেন যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশী চক্রান্ত ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের নামে ভিসানীতি, শ্রমিক অধিকার নীতি প্রয়োগের হুমকি দিয়ে আসছিল। এই পার্লামেন্টে দাড়িয়ে তখনই বলেছিলাম অবাধ নির্বাচন নয়, রেজিমচেঞ্জ বা সরকার পরিবর্তনই তাদের লক্ষ্য। এদেশে তাদের স্বাভাবিক সহযোগি (ঘধঃঁধৎধষ অষষু) ছিল বিএনপি-জামাত। তারা দেশের অভ্যন্তরে সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সব ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করার প্রয়াস নিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও জনগণের প্রতিরোধ তাদের সকল ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। আগুন সন্ত্রাস, ট্রেনে মানুষ পুড়িয়ে মারা, রেল লাইন উপড়ে ফেলা নানা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই নির্বাচনটি হয়ে যাওয়া দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র এবং অসাংবিধানিক ধারার বিরুদ্ধে বিশেষভাবে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক বিজয়। তবে এ কথা সত্য যে নির্বাচন সম্পর্কে জনমানুষকে যে অনাস্থাবোধ তা দুর করা যায়নি। কালোটাকার প্রভাব, বিশেষ সংস্থার নিয়ন্ত্রণ, কোন কোন ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব, শহরাঞ্চলগুলোতে ভোটারদের নগণ্য উপস্থিতি নির্বাচনের বিশ^াসযোগ্যতাকে ক্ষুণœ করেছে। কিন্তু তা কোনক্রমেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না।

মাননীয় স্পীকার,
আমাদের সামনে সাম্প্রতিক পাকিস্তানের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাকিস্তানের মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘লন্ডন ষড়যন্ত্র’ বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের নির্বাচনকেও একই পরিণতি বহন করতে হত।

মাননীয় স্পীকার,
নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকার গঠন সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা। এটা একইভাবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের ১১টি প্রধান প্রতিশ্রুতির প্রথম প্রতিশ্রুতি। বাজার সিন্ডিকেট না ভাঙ্গার কোন কারণ নাই। কারণ কারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের তা জানা। অন্য দলকে এ ব্যাপারে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নিজের মানুষের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে গণ-বণ্টন ব্যবস্থার পূর্ণ রেশনিং চালু করার কথা বলেছিলাম। সরকারকে বিষয়টা আরেকবার বিবেচনার জন্য বললাম।

মাননীয় স্পীকার,
বাংলাদেশে দরিদ্র বিমোচন বিশ^ প্রশংসিত হলেও এই মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফিতী তাকে কোন দৃঢ় ভিত্তি দিতে পারছে না। মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত ক্রমশঃ দরিদ্র, দরিদ্র অতি দরিদ্রে পরিণত হচ্ছে।

মাননীয় স্পীকার,
এর আরেকটি ফলাফল হচ্ছে উচ্চ বৈষম্য। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবই বলছে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের চেয়ে ধনীরা ১১৯ গুণ বেশি আয় করে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব প্রায় পৌনে বিশ লাখ পরিবারের গড় আয় মাত্র ৭৪৬ টাকায়। তারা দেশের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবার। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের মধ্যে ১৯ লাখ ৬৫ হাজার পরিবারের মাসিক গড় আয় ৮৯ হাজার টাকা। ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে ১০% ধনীর হাতে দেশের মোট আয়ের ৪৯%। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ উচ্চ বৈষম্যের দেশে পরিণত হতে চলেছে। বৈষম্যের পরিমাপন গিনি সোহাগের মাত্র .১ দুরে আছে।

মাননীয় স্পীকার,
বঙ্গবন্ধু কেবল আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলেন নাই, তিনি এই ধন বৈষম্যের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। দেশকে বৈষম্যহীন দেশে পরিণত কথা বলেছেন। বর্তমানের এই বৈষম্য বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত বৈষম্যহীন সমাজের নীতির প্রতি বিশ^াসঘাতকতার শামিল।

মাননীয় স্পীকার,
বর্তমান অর্থনীতিক পরিস্থিতি অর্থনীতি ক্ষেত্রে নয়া উদারনীতিবাদ অনুসরণের ফসল। এই নীতিতে মুষ্টিমেয়ের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটে। বাংলাদেশে এই নয়া উদারনীতিবাদেরও বিকৃত প্রয়োগ ঘটছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান ঠিকই বলেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে মুষ্টিমেয় লোক ধন সম্পদের অধিকারী হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন ঋণখেলাপী বর্তমানে বিজনেস মডেলে রূপান্তরিত হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অর্থ পাচার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। বাংলাদেশ ব্যাংকই পরিণত হয়েছে নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে। দুবৃত্তায়িত এই অর্থনীতি বিস্তৃত হয়েছে রাজনীতি ক্ষেত্রে। ক্ষুদ্র ধনিকগোষ্ঠী, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের বৃত্তে বন্দী অর্থনীতি-রাজনীতি। একে এক কথায় অলিগার্কিই হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই অলিগার্কিই দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজনীতি-নির্বাচন এসবই ক্রমশঃই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরছে। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য দুরে থাক, আওয়ামী লীগ যে মিশ্র অর্থনীতির কথা বলেছে তার থেকে তারা আজ যোজন যোজন দূরে। দেশে জন্ম নিয়েছে ‘ঈৎড়হু ঈধঢ়রঃধষরংধস’ যার স্বাভাবিক সম্পর্ক সা¤্রাজ্যবাদের সাথে। আর সা¤্রাজ্যবাদের স্বাভাবিক মিত্র মৌলবাদ। বাংলাদেশ সেই পরিণতির দিকে এগিঃেয় চলেছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।

মাননীয় স্পীকার,
এই ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সমস্যা খুবই প্রাসঙ্গিক। মানবতা থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হলেও তারা আজ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রতি প্রত্যক্ষ হুমকিতে পরিণত হয়েছে। মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের উপর পরছে। এই হুমকির মুখে দাড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা রক্ষা করা আজ কর্তব্য।

মাননীয় স্পীকার,
শেষ করছি এই বলে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সামনের চ্যালেঞ্জগুলো অতি কঠিন। কোন একক দলের পক্ষে এটা মোকাবিলা সম্ভব নয়। প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সংগঠিত করা। শত্রু সা¤্রাজ্যবাদ-মৌলবাদ। এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা থাকলে এখনই ঝেড়ে ফেলুন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ জয়ী হবেই। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। দুনিয়ার মজদুর এক হও।

Share.