শেকল ভাঙার পদযাত্রা এগিয়ে চলুক

0

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অব্যাহত বিক্ষোভ-প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত সোমবারের মন্ত্রীসভা বৈঠকে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদÐের  পাশাপাশি মৃত্যুদÐের বিধান সংযুক্ত করে নারী ও শিশুনির্যাতন আইন সংশোধন করেছেন  এবং সংসদ অধিবেশন না থাকায় আইনের ঐ সংশোধনী অধ্যাদেশ আকারে জারি করেছেন। অধ্যাদেশ জারির সময় থেকেই ঐ সংশোধনী কার্যকর হবে। ধর্ষণজনিত অপরাধ যে মাত্রাছাড়া হয়ে গেছে এবং অবিলম্বে তা নিবারণ করা প্রয়োজন-এই জরুরি বিবেচনা থেকে মন্ত্রীসভায় গৃহীত ঐ সংশোধনী একদিনের মধ্যে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উদ্যোগি হয়ে আইনমন্ত্রীকে এতদসংক্রান্ত সংশোধন উত্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আইন প্রণয়নের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী জনগণের মনের ভাষা ও চোখের ভাষা বোঝেন। আর এ কারণে জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী আইনের এই সংশোধনী এসেছে।

শেখ হাসিনা আন্দোলনের লোক। ’৮১ সালে দেশে ফিরে আন্দোলনের মাধ্যমে দল ও দেশের মানুষকে সংগঠিত করেই ক্ষমতায় গেছেন, জনগণের নন্দিত নেত্রী, জননেত্রী হয়েছেন। আর নারী প্রশ্নে তার সংবেদনশীলতা প্রশ্নাতীত। তিনি নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তা কেবল দেশে নয়, বিশে^ও তাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

কিন্তু ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। আর সে ক্ষমতা যখন এ্যাবসলুট হয় তখন সেটা চোখের সামনে সব কিছুকে মুছে দেয়, নিজের চারপাশের বৃত্ত ছাড়া। সে ধরণের বৃত্তই গড়ে ওঠেছে। সেখানে রাজনীতিকদের অবস্থান বেশী নয়, দলীয় অবস্থান অনুসরণ করা ছাড়া। সে কারণেই আমরা দেখি সিলেট-নোয়াখালীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-তরুণরা বিক্ষোভ করছে, প্রতিবাদী গান গাইছে, ছবি আঁকছে, মিছিলে পুলিশের মুখোমুখি হয়েছে, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিপুল শক্তি থাকার পরও তারা কার্যত: নিশ্চেষ্ট ছিল, নিস্প্রভ ছিল। হয়ত অপেক্ষা করছিল ক্ষমতার শীর্ষ কি মনোভাব নেয়। বরং তারা অনেক উৎসাহী থেকেছে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুর ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত জনৈক ছাত্রীর ধর্ষণ ও ধর্ষণের সহায়তার জন্য দায়ের করা অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু যেই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী পদক্ষেপ নিলেন, অমনি বিশাল আনন্দ মিছিল বের করেছে। জানিনা এ ধরণের কর্তার ইচ্ছায় কর্মাধীন অনুসারীদের দিয়ে বিপদকালেত বটেই, সুখের সময়েও কোনো ভাল কাজটি করা সম্ভব কিনা। মাঝে মাঝে মুখে কালিলেপে দেয়া ছাড়া।

যা’হোক যে বৃত্তের কথা বলছিলাম তাতে রয়েছে অঢেল সম্পদের মালিক ব্যবসায়ী, এই করোনাকালেও যাদের বিত্তের স্ফিতী ঘটেছে। রয়েছে সামরিক-বেসামরিক আমলা। এই সরকারের উপর ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ কত শক্ত তার প্রমাণ খেলাপী ঋণ সংক্রান্ত বিধান। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী যার ইংরেজী খসড়া অর্থমন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুগতের মত তা সার্কুলার আকারে প্রকাশ করে। ঐ খেলাপী ঋণ পরিশোধের সুবিধা করোনাকালে আরো বিস্তৃত হয়েছে। আর অর্থনীতিকে সচল রাখতে করোনা সংক্রমণের শুরুতেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে অর্থনৈতিক প্যাকেজসমূহ ঘোষণা করেন তাতে মধ্যম ও ছোট শিল্প ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবস্থা থাকলেও পাবার বেলায় তারা বঞ্চিতই থাকছে, পাচ্ছে বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পগ্রæপগুলো। করোনা নিয়েও নিষ্ঠুর ব্যবসা হয়েছে এবং হচ্ছে ভ্যাকসিন নিয়েও। সে কথা এখানে নয়। যে বৃত্তের কথা বলছিলাম তাতে মূল জায়গায় রয়েছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, যাদের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলা যাবেনা বলে সম্প্রতি পরপর দু’টি কি তিনটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

একথা সত্য যে দেশের বাইরে থেকে কিছু ব্যক্তি রাজনৈতিক নেতা, সরকার, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও দায়িত্বপূর্ণ পদে কর্তব্যরত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে অলীক কাহিনী, ঘৃনা প্রচার করছে। কেবল তাই নয়, ধর্মের নামে বিভিন্ন হুজুরদের বক্তৃতায় নারী সম্পর্কে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে, জাতীয় সংগীত সম্পর্কে সামজিক মাধ্যমে যা প্রচার হচ্ছে তাতে কানে হাত দিতে হয়। বিটিআরসি-র পক্ষে এসব বন্ধ করা সম্ভব। সাইবার আইনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের পক্ষে সংবিধান বিরোধী, সমাজ অগ্রগতি বিরোধী সরকারের নীতি বিরোধী যে সব কথা বলা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব কেবল নয়, আইনের প্রয়োগ করাও সম্ভব বটে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে পুলিশের তরফ থেকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধের কথা ও তদ্সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে তা মূলতঃ রাজনৈতিক মত প্রকাশ, স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে। এসব নির্দেশনায় রাষ্ট্র ও সরকারকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাÐ অবশ্যই বর্জনীয়, কিন্তু সরকারের কোনো পদক্ষেপ সমলোচনা করা যাবেনা, তা’হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা দানকারী সংবিধানের বিধান কোথায় দাঁড়ায়।

শুরু করেছিলাম ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইনের সংশোধন নিয়ে। ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদÐের বিধান অমানুষ হয়ে যাওয়া পশুদের কিছুটা হলেও নিবৃত্ত করবে। প্রধানমন্ত্রী ধর্ষণকারীদের পশুর সাথে তুলনা করেছে এবং পাশবিকতা দমনে আইনের সংশোধন করা হয়েছে বলে বলেছেন। এটা ঠিক যে, এই সংশোধনী কিছুটা হলেও ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে আনবে। কিন্তু আইন ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাই একমাত্র প্রতিবিধান নয়। এক্ষেত্রে যেমন আইন প্রয়োজন, আইনের প্রচলিত বাধাসমূহত দূর করা প্রয়োজন, তার চাইতে বড় প্রয়োজন আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো রয়েছে তা দূর করা। এবং সবচাইতে আরো যেটা প্রয়োজন তা’হল সামাজিক প্রতিরোধ। আর এই সামজিক চেতনা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নারী সম্পর্কে রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন দরকার। রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে নারীর অবস্থান ও অংশগ্রহণ ক্ষমতায়নত বটেই। কিন্তু নারীর ব্যাপারে যে দৃষ্টিভঙ্গী বর্তমান, যে আচার আচরণ পরিবার, সমাজ, কার্যক্ষেত্রে  পথচলায় সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে তাকে বদলাতে হবে। শিকল ভাঙতে হবে।

এতদিন ঘরে ধর্ষণের বিরুদ্ধে বহু জমায়েত-বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়েছে। এর মাঝে বেশ কিছুরই রাজনীতির চড়া রঙও আছে। অবশ্য লুকেয়াছাপা করে যাতে সাধারণ তরুণ-তরুণীরা আগ্রহ না হারিয়ে ফেলে। পোষা পাখি দিয়ে বনের পাখি ধরার প্রয়াসও আছে। সেজন্য তাদের উচ্চকন্ঠ প্রতিবাদকে গ্রাহ্যকরে আইনের যে সংশোধন হয়েছে তারা একে আন্দোলনকে দিকভ্রান্ত করার অপকৌশল বলছে। ইলাষ্টিক বেশী টানলে ছিড়ে যায় এ বোধ তাদের থাকলে ভাল হত। কিন্তু এর মাঝেও যেটা আশাবাদ জুগিয়েছে তা’হল তেরতারিখ মধ্যরাতে বিশাল একদল তরুণীর শেকল ভাঙার পদযাত্রার খবর। না মধ্যরাতে সেটা দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু সকালের খবরে ঐ সব তরুণীর প্রত্যয়দীপ্ত চেহারাগুলো দেখে আশ^স্থ হয়েছি। মনে এই দৃঢ় প্রত্যায় জন্মেছে এ দেশের তারুণ্য জেগে আছে রাষ্ট্র ও সমাজের অতন্ত্র প্রহরী হয়ে। তারা যেসব দাবী তুলেছে তা ইতোমধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। তারা মধ্যরাতে নিজেরা জেগে থেকে অন্যদের জাগাতে বার দফা যে কথাগুলো বলেছে তা’হলো -(১) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদÐের সঙ্গে সামজস্য রেখে আইনে ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন সংস্কার করতে হবে, (২) পাহাড় ও সমতলের সব নারীর উপর সামরিক ও বেসামরিক সব প্রকার যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে, (৩) জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষ যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে যেকোনোভাবেই ‘ভিকটিম বেøমিং’ (দোষারোপ করা বা নিন্দা জানানো) বন্ধ করতে হবে। গ্রামীণ সালিশ বা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে হবে, (৪) প্রাথমিক থেকেই পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি বা কনসেন্টের গুরুত্ব, প্রাইভেট পার্তাস সম্পর্কে অবহিত করা) যুক্ত করতে হবে,

(৫) ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্য্যকর করতে হবে,

(৬) হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল বাস্তবায়ন ও কার্য্যকর করতে হবে।

(৭) সিডও সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে,

(৮) মাদ্রাসা ‘শিশুসহ সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে,

(৯) জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তক নারী অবমাননাকর বার্তা প্রকাশ ও প্রচার করা নিষিদ্ধ করতে হবে,

(১০) রাস্তাঘাটে নারীদের অযথা পুলিশী ও অন্যান্য হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

(১১) ধর্মীয় বক্তব্যের নামে অনলাইন ও অফলাইন নারী অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার বন্ধ করতে হবে,

এবং (১২)  যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের সুবিচারে হটলাইনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

শিকল ভাঙার পদযাত্রা এগিয়ে চলুক। আওয়াজ ওটুক নারীর অধিকার, মানবাধিকার।

 লেখকঃ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সভাপতি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

Share.