সংগ্রাম আত্মত্যাগের এক শতাব্দী:শান্তনু দে

0

১৭ অক্টোবর ১৯২০, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ইউনিটের যাত্রা শুরু। সেখান থেকেই এই উপমহাদেশে কমিউিনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন। আবার ওই বছরই অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা এবং তা মোটেই কাকতালীয় নয়। পরের বছরই অমর ¯েøাগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। আজ কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ মানে কোনো সূচক নয়। একশ’ মানে নিছক কোনো সংখ্যাও নয়।
একশ’ মানে স্বাধীনত ভারতের চেহারা নির্মাণে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কমিউনিস্টদের নির্ণায়ক ভূমিকা। জরুরি ইস্যুগুলিকে জাতীয় এজেন্ডার কেন্দ্রে নিয়ে আসা। বিরাট আত্মত্যাগ। শহীদিবরণ। একটি তথ্যই যথেষ্ট, ১৯৪৩ সালে বোম্বাইয়ে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে যে ১৩৮ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন, তারা সবা জেলে ছিলেন ১৪ বছর।
একশ’ মানে ১৯২১, আমোদাবাদে কংগ্রেসের অধিবেশনে কমিউনিস্টরাই প্রথম তোলেন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। পূর্ণ স্বাধীনতার এই দাবি তোলেন একজন মওলানা, আর একজন স্বামী। মওলানা হসরত মোহানি আর স্বামী কুমারানন্দ। পরের বছর আবার, কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে কমিউনিস্টরা তোলেন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। গান্ধীজির তখন পছন্দ হয়নি। আট বছর পর, শেষে ১৯২৯-এ কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে গৃহীত হয় পূর্ণ স্বরাজের ¯েøাগান। ১৯৩১, করাচি অধিবেশনে স্বাধীন ভারতের রূপরেখা।
১৯২২, কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে কমিউনিস্টরা যে ইশতেহার বিলি করেন, তাতে ছিল শ্রমিক ইউনিয়নের স্বীকৃতি, আট-ঘণ্টার কাজের অধিকার, ন্যূনতম মজুরির জন্য লড়াই-আন্দোলনের ডাক। গয়া কংগ্রেসের এই ইশতেহারের কথাই পরে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯২৪) ব্রিটিশ পুলিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ হিসেবে পেশ করে। ২ অক্টোবর, ১৯৩৯। একশ’ মানে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজার পর এই বিশ্বে প্রথম বোম্বাইয়ে শ্রমিকশ্রেণির যুদ্ধ-বিরোধী ধর্মঘট। যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্টরা। অবশ্য তার আগেই জুলাই, ১৯০৮। ‘দেশদ্রোহের’ অভিযোগে তিলকের ছ’বছর কারাবাসের সাজা ঘোষণা। ইতিহাসবিদ বিপান চন্দ লিখছেন প্রতিবাদে সমস্ত সুতাকল ও রেলশ্রমিকদের সর্বাত্মক ধর্মঘটে স্তব্ধ বোম্বাই। নামানো হয় সেনা। রাস্তায় শহীদ হন ১৬ জন শ্রমিক। আহত আরও ৫০ জন। ভারতে শ্রমিকদের ধর্মঘট দেখে ‘ইনফ্লেবেল ম্যাটেরিয়াল ইন ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স’ নিবন্ধে ভøাদিমির লেনিন লিখলেন, ‘ইতোতমধ্যে ভারতেও সর্বহারা জনগণ সচেতন রাজনৈতিক গণসংগ্রাম গড়ে তুলছেন। এবং তার ফলে ভারতে রুশ ধাঁচের ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার হালও শোচনীয় হয়েছে।’ কমরেড বিটিআর লিখছেন ‘এই প্রথম শ্রমিকশ্রেণি সমস্ত শিল্পে তার শক্তিশালী হাতিয়ার ধর্মঘটকে ব্যবহার করল একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য এবং দেখালো সাধারণ মানুষকে জড়ো করতে পারার দক্ষতা।’ ১৯২৪-২৯, দেশজুড়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, তথা ধর্মঘটের জোয়ার। ১৯২৮, বোম্বাইয়ের দেড় লক্ষ বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক এক বীরত্বপূর্ণ ধর্মঘটে। দীর্ঘ ৬-মাস ধরে চলে এই ধর্মঘট। ১৯২৯, দু’শোর বেশি ধর্মঘটে শামিল হন পাঁচ লক্ষের বেশি শ্রমিক। এইসব ধর্মঘট-সংগ্রামে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে তোলা হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগেই কমরেড সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়রের নেতৃতে ভারতে প্রথম মে দিবস উদযাপন করা হয়। এই চেট্টিয়ারই পরে, ১৯২৫’র ডিসেম্বরে কানপুরে কমিউনিস্ট গ্রæপগুলির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। যেখান থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার সদরদপ্তর হয় বোম্বাই। মে দিবসেই প্রথম অবিভক্ত ভারতের আকাশে লাল ঝাÐা উড়ে। একইসঙ্গে পালিত হয় দুই জায়গায়। একটি মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিপরীতে সমুদ্রতটে। অন্যটি ট্রিপিকিন সমুদ্র সৈকতে। সভা থেকে মে দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়। সেইসঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনে শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেওয়া হয়। পরদিন ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সেই প্রতিবেদন। একশ’ মানে সুভাষচন্দ্র বসুর রানি ঝাঁসি বাহিনীর নেতৃত্ব থাকা ল²ী সায়গল, যিনি ছিলেন সিপিআই(এম) সদস্য। একশ মানে, সেলুলার জেল। স্মৃতিফলকে লেখা নামের আশি শতাংশই অবিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাবের কমিউনিস্ট। হরেকৃষ্ণ কোঙার থেকে সুধাংশু দাশগুপ্ত। যেমন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের অন্যতম সদস্য কল্পনা দত্ত থেকে গনেশ ঘোষ, সতীশ পাকডাশি থেকে সুবোধ রায়। ১৯৪২, ভারত ছাড়ো আন্দোলন। তার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে ১৯৯২ সালের ৯ আগস্ট রাত বারোটায় সংসদের বিশেষ অধিবেশন। রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা ভাষণ দিতে গিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল ‘ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীর’। সাতচল্লিশে দেশভাগ হলেও কমিউনিস্ট পার্টি তখনো এক। সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ। ২৮ ফেব্রæারি থেকে ৭ মার্চ, ১৯৪৮। কলকাতায় মহম্মদ আলি পার্কে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। ওই কংগ্রেসে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে যেমন প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছিলেন, তেমনই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা প্রতিনিধিরা। কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে যে তিনটি খসড়া প্রতিবেদন পেশ করা হয়, তার একটি ছিল পাকিস্তানের জন্য পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন। পাকিস্তানের জন্য একটি পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদনটি পেশ করেন ভবানী সেন। ব্যাপক ভোটে তা গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তানের উভয় অংশের (পূর্ব ও পশ্চিম) প্রতিনিধিরা ৬ মার্চ একসঙ্গে বসে পৃথক অধিবেশন থেকে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করবেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বিটি রণদিভে। দুই পাকিস্তান থেকে আসা প্রতিনিধিরা ৬ মার্চ বিশেষ অধিবেশন থেকে গঠন করেন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন অল ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পশ্চিম পাকিস্তানের সাজ্জাদ জাহির। যদিও ২০০০ কিলোমিটার ভারত ভূখ দ্বারা বিচ্ছিন্ন সেই কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কখনোই ভালো করে বসতে পারে নি। শেষে ১৯৫৬, কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখা এক সম্মেলনের আয়োজন করে। তা গোপনে অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। সেখান থেকেই গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি।
একশ মানে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং পরে অসংখ্য বিপ্লবী ও শহীদের বিপুল আত্মত্যাগ। আর পার্টির নেতৃত্বে এই গৌরবময় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতের ইতিহাস বিকাশে এক উজ্জ্বল অবদান। একশ মানে, জনগণের প্রকৃত সমস্যা ও ইস্যুকে জাতীয় স্তরে তুলে ধরা। নতুন ভারত নির্মাণের প্রতিটি প্রশ্নে কমিউনিস্টরা। জমির প্রশ্নকে তোলা। জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে জমির লড়াই। তেভাগা তেলেঙ্গানা। ভূমি সংস্কারের প্রশ্নকে জাতীয় এজেন্ডায় পরিণত করা। ভাষার বিপুল বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ভাষার ভিত্তিতে রাজনৈতিক মানচিত্র তৈরিতে অন্যান্যদের সঙ্গে সংগ্রাম। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই ১৯৩১, কমিউনিস্ট পার্টিই প্রথম ড্রাফ্ট প্ল্যাটফরম অব অ্যাকশানে জাতপাত ব্যবস্থা ও অস্পৃশ্যতার অবসানের ডাক দেয়া। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, সকলকে নিয়ে ভারত গড়ার কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে পৃথক বলে না ভাবা। কমিউনিস্টদের নীতিগত অবস্থান হল: ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা। বস্তুত, কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পরপরই ১৯২০’র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে পার্টির তরফে এম এন রায় লিখেছিলেন, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের একমাত্র প্রতিষেধক হল সমস্ত জাত-সম্প্রদায়ের শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি ঐক্য। একশ’ মানে কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় রাজ্য সরকার চালানোর অনন্য অভিজ্ঞতা। এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও বিকল্পের দিশা দেখানো। আবার একশ’ মানে, শুধু ইতিহাস চর্চা নয়, পিছনে ফিরে দেখা নয়, আজকের সময়কে মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। নয়া উদারবাদের জমানায় শ্রমিক শ্রেণির ব্যাপকতম ঐক্য নির্মাণে ব্রতী কমিউনিস্টরা। এই সময়ে ১৯টি সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট। বিশতম ধর্মঘট হতে চলেছে এই ২৬ নভেম্বর।
একশ’ মানে, নৌ-বিদ্রোহের সেই গান-‘মন্দির মসজিদ গির্জাঘর নে বাঁট দিয়া ভগওয়ান কো ধরতী বাঁটি, সাগর বাঁটা, মাত বাঁটো ইনসান কো।’ একশ মানে আপসহীন শ্রেণি সংগ্রামে অবিচল থাকার প্রত্যয়। শ্রেণি সংগ্রাম অনিবার্যভাবেই রাজনৈতিক সংগ্রাম, মতাদর্শগত সংগ্রাম। শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে যা আজ অনেক বেশি জরুরি। লক্ষ্য শ্রেণি শোষণ ও সামাজিক নিপীড়ন মুক্ত ভারত। একশ’ মানে, ‘হম ভুখসে মরনে ওয়ালে/ কেয়ামত সে ডরনে ওয়ালে…।’
লেখকঃ সহযোগী সম্পাদক, ‘মাকর্সবাদী পথ’ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তাত্তি¡ক পত্রিকা।

Share.