রনো চলে গেলেন। এগার মে’র ভোররাত দুইটা পাঁচ মিনিটে তার দেহাবাসন ঘটেছে। তাঁর এই মৃত্যু আকস্মিক ছিলনা। দীর্ঘদিন থেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। চব্বিশ ঘন্টাই অক্সিজেন নিয়ে থাকতে হত। সঙ্গে ছিল কাশি। ভুল চিকিৎসার কারণে এক চোখে একদম দেখতে পারতেন না। আরেক চোখে অবস্থা দেখতেন। কিন্তু এই অবস্থায় তার রাজনৈতিক জীবনের মত যে লড়াইটা তিনি লড়েছিলেন তা’ছিল অতুলনীয়। শারিরীক এই অবস্থার মধ্যেও ডিকটেশনে তিনি বই লিখেছেন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। ক’দিন আগে শেষবার যখন তার সঙ্গে কথা হল জানালেন মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা লেখা লিখেছেন। নতুন দিগন্ত পত্রিকায় সেটা ছাপা হবে। কিন্তু তার ক’দিনের মধ্যেই দ্রুত তার শারিরীক অবনতি হয়। খবর পেয়ে ‘হেলথ এ্যান্ড হোপ’ হাসপাতালের এইচডিইউ-তে যখন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, আছন্ন অবস্থাতেই আমাকে ডেকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন। কি কথা বলতে চেয়েছিলেন বুঝতে পারিনি। তবে চিনতে পেরেছিলেন ভেবে ভাল লাগছিল। খাওয়ার আগে রাত দশটায় আবার গিয়েছিলাম আমার ডাকে সাড়া দিয়ে চোখ মেলেছিলেন। কিন্তু চিনতে পেরেছিলেন কিনা বুঝতে পারিনি। একটা সময় ছিল, এই সেদিন পর্যন্ত রণো-মেনন নামে সবাই আমাদের চিনত। কিন্তু ২০০৮-এর সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। কিন্তু তার সাথে অবশ্য যে বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্ব অটুট থেকেছে মৃত্যু পর্যন্ত।
রণো আপাদমস্তক কমিউনিস্ট ছিলেন। সেই ছেলেবেলা থেকেই কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি তার আকর্ষণ আমার মধ্যেও সংক্রমিত করেছিলেন। আমি শেষ পর্যন্ত কতখানি কমিউনিস্ট হতে পেরেছি জানিনা। তবে তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্রজীবন থেকে যে কমিউনিস্ট আদর্শ আকড়ে ধরেছিলাম দু’জনে মিলে সেই আদর্শে অবিচল থেকেছি এই শেষ বয়স পর্যন্ত। আর এই ক্ষেত্রে রণোর প্রতি আমার অকৃত্রিম ঋণ। আন্দোলনের পথচলায়, জেল খানায়, ব্যক্তিজীবনে বন্ধুদের আড্ডায় তার কাছ থেকে কমিউনিজমের পাঠ নিয়েছি। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বাক-মোড়ে, ষাটের দশকের মহাবিতর্কের সময় এক সাথে মিলে তাতে অংশ নিয়েছি।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা প্রয়োগ করেছি। বিপ্লবী আবেগে কখনও কখনও তাতে ভুল করেছি। আবার রণোই আবার সর্বাগ্রে ভুল শুধরে সঠিক পথ বাতলেছে। তবে শেষবার যে বিষয় নিয়ে তার সাথে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল সেই ক্ষেত্রে সে সময়কার রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে তারই অগ্রগামী ভূমিকা ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি যেটাকে ভুল মনে করেছিলেন তাতে আমি সায় দিতে পারিনি। ফলে আমাদের দু’জনের রাজনৈতিক পথ, এমনকি সাংগঠনিক পথও ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল এখানে কে আমরা সঠিক ছিলাম সেটা ভবিষ্যতের ইতিহাস নির্নয় করবে। কিন্তু রাজনীতির ও সংগঠনের ঐ কঠোর বিচ্ছিন্নতা আমাদের পৃথক করতে পারেনি। রণোর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই বিচ্ছিন্নতা চূড়ান্ত হল কি? আমি মনে করি না। রণো সাথে যে আত্মিক, রাজনৈতিক আদর্শগত বন্ধুত্ব ছিল তা তাঁর ও আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়েও অটুট থাকবে।
সেই ছোটবেলার কথা। যশোর জিলা স্কুলে একসাথে পড়া, খেলাধুলা, এক সঙ্গে সিগারেট খাওয়া শেখা। এ দেশে তখন উন্মাতাল সময়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদের রক্তের স্মৃতি জ্বল জ্বল করছে। যুক্তফ্রন্ট গঠন হয়েছে।
সামনে নির্বাচন। ঢাকা থেকে বড় তিন ভাই ফিরে এসেছেন ভাষা আন্দেঅনে অংশ নিয়ে। জেলখেটে। মুসলিম লীগের ভাবাদশি জেলা জজ পিতার বাসায় আলাদা আবহাওয়া। ঐ ততোধিক না বোঝার বয়সেও ভাষার প্রশ্ন স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্ন, সাম্যের প্রশ্ন কিশোর মনকে আন্দোলিত করছে। এই সময় রনো এল কমিউনিস্ট দেখার আমন্ত্রণ নিয়ে।
রনোর জন্ম কলকাতায়। তার নানা সৈয়দ নওশের আলী তখন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ। সে সময় কংগ্রেস ছেড়ে বামপন্থার দিকে ঝুকছেন। মামা সৈয়দ মনসুর জিলানী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই আবহাওয়ায় রনোর কমিউনিজমের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। বাসায় বড় ভাইয়ের সাম্যবাদের প্রতি আকর্ষণ আমার মধ্যেও ঐ চিন্তার অঙ্কুরোদগম ঘটাচ্ছিল। আর তখনই রনোর ঢোলের বাড়ী। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের গুলীহত্যার ঘটনায় আহত হয়ে বেঁচে যাওয়ার তরুণ কমিউনিস্ট আব্দুল হক তখন চুয়ান্ন’র নির্বাচনে মুসলিম লীগের দাপুটে প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাকে ঐ নির্বাচনে প্রচারণার জন্য আনা হয়েছে যশোরে। যশোর রেলস্টেশনে রনো আমাকে নিয়েছিল আহত রাজবন্দী কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হককে দেখতে।
সেই প্রথম একজন কমিউনিস্ট দর্শন। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন রনোই আবার আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিস্টদের সুলুক সন্ধান দিয়েছে। এরপর আর কথা হয়নি। দু’জনে মিলে কমিউনিস্ট আদর্শের পথ বেয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি। বাষট্টির সামরিক শাসন বিরোধীও শিক্ষায় আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন পুনগর্ঠন, আয়ুব সামরিক শাসন বিরোধীতা, লড়াইয়ে, আত্মগোপনের জীবনে, জেলখানায়, ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তিতে, রনো শ্রমিক আন্দোলনে, আমি কৃষক আন্দোলনে, আবার একত্রে ‘কমিউনিস্ট পার্টির বিভক্তির সময়কালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি’ গঠনের মধ্য দিয়ে এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্গঠন করার কাজে।
এ সময়টা ছিল আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। রনো শ্রমিক আন্দোলনে, আমি কৃষক আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর সাথে। এ সময় আমরা ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে পল্টনের জনসভায় (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০) ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কর্মসূচি’ ঘোষণা করি। দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করি জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া পূর্ববাংলার মানুষের স্বাধীনতা আসবে না। মুক্তি আসবে না।
এর পরবর্তীকালে ’৭০ এর নির্বাচন, ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতকরণ, অসহযোগ আন্দোলন, সাতই মার্চের ভাষণ, পঁচিশে মার্চের কালো রাত্রির গণহত্যার মধ্য দিয়ে ঐ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পথে আমরা অগ্রসর হয়েছি। ঢাকার অদূরে নরসিংদীর শিবপুর কেন্দ্রীয় ঘাটি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা অংশ নিয়েছি। এই সময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তথাকথিত পিকিংপন্থীদের একত্রিত করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন। মওলানা ভাসানীর অবর্তমানে তাকেই প্রধান করে এই কমিটি ২রা জুন ১৯৭১ যে ঘোষণা গ্রহণ করে তারও রচয়িতা ছিলেন রনো।
বাংলাদেশ পরবর্তীকালে এই ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি অপর দুটি কমিউনিস্ট গ্রুপ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার) ও কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) নামে প্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলে রনো তার সম্পাদকম-লীর সদস্য হন। অন্যদিকে আমি একইভাবে ঐ পার্টির সম্পাদকমন্ডলীতে থাকলেও আমার প্রকাশ্য অবস্থান হয় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ও কৃষক সমিতিতে। এরপর ভাসানী ন্যাপ থেকে বেরিয়ে এসে ইউপিপি গঠন ও কাজী জাফররা সেই ইউপিপিকে নিয়ে জেনারেল জিয়ার ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে’ যোগ দিলে আমি আর রনো অন্যদের নিয়ে তাতে যোগদান করতে অস্বীকার করে বেরিয়ে এসে গঠন করি ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ নামে প্লাটফরম। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রকাশ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি নামে পুণর্গঠিত করা হবে। এবং রনো তার সাধারণ সম্পাদক হন।
এরপর বহু ভাগ বিভক্তি ঐক্যের মধ্য দিয়ে রনোই সবচেয়ে উদ্যোগী ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে। সেই ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে রনো ২০০৮ সালে বিদায় নেন এবং যোগদেন যে মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিকে তিনি এ যাবতকালে বিরোধীতা করেছেন। সেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে। সেই পার্টির উপদেষ্টা হিসাবে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু এই সময়কালে রনোর প্রধান মনোযোগ ছিল মার্কসবাদী তত্ত্বমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায়, বই লেখায়, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ওপর নানা বিষয়ে এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে গ্রন্থ রচনায়। রনোর লেখা আত্মজীবনীমূলক বই ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ ষাটের দশক ও সত্তরের দশকের প্রথমার্ধকে মূর্ত করে তোলে পাঠকের কাছে।
আমার লেখার শিরোনামে রনোকে কমরেড হিসাবে বলেছি। কিন্তু সারা লেখায় তাকে কমরেড হিসাবে বলিনি। রনো আমার কাছে কমরেডই নন তার চেয়ে বড় কিছু। রাজনীতিতে আমাদের জোড় ভেঙ্গে গিয়েছিল পনের বছর আগে। এবার তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে আমাদের সত্যিকার জোড় ভাঙল। তবে রনোর সাথে আমার আবাল্য বন্ধুত্ব পরিণত বয়সে যে পরিণীতি নিয়েছে তা অটুট থাকবে আমাদের মৃত্যুর পরও।
কমরেড রনো, যুগ যুগ জিঁও।